আজ ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২রা ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

যৌণ পল্লীর একদিন— রাসেল উদ্দিন

সেদিন যৌণ পল্লীর রাস্তা ধরে মেসে ফিরছিলাম, টলমলে যৌবণ চুষে খাচ্ছে মস্তিষ্ক, স্টেশনের পাশ বেয়ে সারি সারি পলিথিন আর পাটের বস্তা মুড়িয়ে সংসার পেতেছে স্বপ্নবাজ পুরুষের দল, সাহিত্যে যাকে বস্তি বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বহু গুনী লেখক।

রোজ মেসে ফেরার সময় বস্তির পাশ ঘেসে আসতে হতো। ডান পাশে পলিথিনে মোড়ানো ছোট্ট টংয়ের পাশে গাঢ় মেকাপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম একদল যুবতীকে। ল্যামপোস্টের আলোয় ঝিলমিল করতো চেহারা গুলো।

নানান রকম ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কেউ পাইজামাটা টেনে নিচ্ছে হাঁটুর উপরে, কিছু একটা সংকেত; চেয়ে দেখতাম, আমি ভীতু মানুষ- যৌবনতা ছিলো মস্তিষ্ক জুড়ে বুকে সাহস ছিলো না। স্তব্ধ হয়ে ছিলো সেদিনের বিকেল- মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছে সেদিন, পরিত্যাক্ত রেল লাইনে বসে আনমনে ভাবছিলাম নশ্বরের যত ভাবনা। কিশোর বয়সে ভাবনাতে বেঁচে থাকতাম।

কি জানি ভর করলো শরীরে, যৌণ পল্লীর পাশের রাস্তায় সেদিন মেলা জমেছে। পকেটে খুঁচরো কয়টা টাকা ছিলো, মাসের শেষে আমি খুঁচরো টাকার ভীষণ কদর করতাম। সেদিন খুব ইচ্ছে হলো ভিতরে সাহস নিয়ে ঢুকে পড়বো, ভাবতে ভাবতে ভিতরে চলে গিয়েছি। এ এক অন্য পৃথিবী, দরজা খুলে হাসতে হাসতে শ্যামলা বর্ণের নটির ঘর থেকে ছাপ কোর্তা পড়া ভদ্র লোক বেরিয়ে চারপাশে একটু দেখে হাঁটা শুরু করলো।

অনেকটা সময় পর বুঝতে পারলাম এই হাসি সুখের হাসি, পৃথিবীকে ভুলে থাকা কয়েক মিনিটের হাসি। কাড়ি কাড়ি সম্পদ মূল্য হারিয়ে ফেলেছিলো তখন এ হাসিতে। পিছনে কেউ একজন মিষ্টি সুরে ডাকলো, “এই যাবা নাকি”?? বুকটা ধরপর করে উঠলো, বীভৎস রকমের ভয় পেয়ে গেছি। এই পৃথিবীটা আগে কখনো দেখা হয়নি, পৃথিবীর অক্সিজেন নিয়ে অন্য কোন পৃথিবীতে পড়ে আছি বোধ করলাম।

পকেটের দিকে তাকিয়ে মাসের শেষ পাঁচটা দিনের কথা মনে পড়লো, মিলের টাকা কম পড়ে যাবে। বাড়িতে অভাব, বাড়তি টাকা আসবেনা জানি। মাথাটা নিচু করে বেরিয়ে এসে বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়েছি। কিছু একটার অপূর্ণতায় এরকম স্বস্তিবোধ কখনো হয়নি আমার। খুব শান্তি পাচ্ছিলাম কিছু না পেয়েও, বিবেকর ভয়ে লুকিয়ে থাকা সত্তার মুক্তিতে হয়তো।

দু’শ টাকা ছিলোনা বলে দু’শ কোটি সুখ পেয়েছিলাম, পবিত্রতার সুখ। অথচ কিছুক্ষণ আগেও কেউ বদ্ধ রুমে সহস্র কোটি মুল্যের সুখ নিয়েছে নর শরীরের। কার সুখটা ভারি, আমার নাকি ভদ্র লোকটার। তাকে ভদ্রলোক বলা অন্যায় হয়নি আমার, সমাজ তাকে ভদ্র লোক বলেই জানে হয়তো।

ভাবতে ভাবতে হাপিয়ে গেছি, সূর্যটা মাথার উপর বরাবর হয়ে আছে, তৃষ্ণা পেয়েছে খুব… বস্তির পাশের লেবু চিপে পানি বিক্রি করে রোজ এক মধ্যবয়সী নারী, ঘরে অসুস্থ স্বামী- ছোট্ট একটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে সম্পর্কে তার ছেলে। এক টাকার লেবুতে দু’গ্লাস পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করে। চোখে পড়লো টুপ করে মহিলার ঘাম পড়েছে লেবু গ্লাসে, লোকজনের সেসব দেখার সময় নেই, তৃষ্ণা ভরা গলায় ঢেলে শান্তি নিয়ে পথ হাঁটা শুরু করে।

আমার তৃষ্ণা মিটে গেছে দৃশ্যটা দেখার পর। মাথায় যৌণ পল্লী নেই, নটি গুলোর সংকেতও নেই। এখন শুধু ভাবছি লেবুর সরবতে এক ফোঁটা ঘাম। অভাবের শরীরের ঘাম পড়েছে, পাপ পুন্য হিসেব মেলাচ্ছি, পাপা হবে নাকি হবেনা, অভাবীর ঘামে পাপ থাকে কিনা জানা নেই।

দুইটা ভিন্ন পৃথিবী চোখের সামনে, কেউ সুখ বিলিয়ে টাকা পাচ্ছে… আর কেউ অভাবের চাকা ঘুরিয়ে ঘাম মিশিয়ে সরবত দিচ্ছে… যৌণ পল্লীর নর্তকীর যৌণ অভাবটাও মেটেনি, সরবত বিক্রেতার পাটের ঘরে টিনও লাগেনি। কে সুখে? সুখ কোথায়? শরীরে নাকি ঘামে। পাশে হেবলার মত দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিও কি সরবত বিক্রেতা হবে? নাকি সে পাড়ার বড় মস্তান হবে? আমি কি দেখে মরতে পারবো? নাকি অকাল মৃত্যুর সংবাদ পড়ে যাবে আমার পাড়ায়…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর..

ফেসবুকে আমরা

Facebook Pagelike Widget