আজ ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২রা ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

২০২০ সাল, এ যেন বিপর্যয়ের গোডাউন

এ যেন দুর্যোগের চক্রব্যুহে বর্ষ। করোনাভাইরাসের জেরে সব হিসেব এমনিতেই ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে দেশের নানা প্রান্তে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে ভয়াবহ এক অশনিসঙ্কেত যেন অপেক্ষা করছে। অন্যদিকে ভারতের লাদাখ সীমান্তে বহিঃশত্রু চিনা ড্রাগনদের চোখরাঙানি। পশ্চিম ও মধ্যভারত জুড়ে পঙ্গপালের হানা। সাইক্লোন আমফান (প্রকৃত উচ্চারণে উম পুন)-এর দাপটে লন্ডভন্ড বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা। দাবানলের গ্রাসে উত্তরাখণ্ড। সব মিলিয়ে দেশের প্রায় সব প্রান্তেই যেন গ্রাস করছে একের পর এক বিপর্যয়। সমস্ত দুর্যোগের মিলিত প্রতিফলন যে কতটা ভয়াবহ, তার আঁচ করতেই হিমশিম খাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি, দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।

দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছিল ৭ মার্চ (শনিবার) ইতালী ফেরত বাংলাদেশী প্রবাসীর শরীরে। সেটাই যেন ছিল সূত্রপাত। তার পর থেকে সময় যত গড়িয়েছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়ে গিয়েছে ৩৮ হাজার। সমান তালে বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও। মৃত সাড়ে ৫ শতরও বেশি মানুষ। দেশে দফায় দফায় লকডাউন ও ছুটি চলছে। তার প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও হিসাব যেন কিছুতেই মিলছে না। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এর শেষ যে কোথায় আপাতত বিজ্ঞানী, চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ— কারও জানা নেই।

কিন্তু আদি-অনন্ত কাল ধরে তো আর লকডাউন চালানো সম্ভব নয়। তাই, করোনার সঙ্গেই বাঁচতে হবে— এই মন্ত্রকে হাতিয়ার করে একটু একটু করে সচল হতে শুরু করল জনজীবন। ফিরলেন পরিযায়ীরা। বিভিন্ন অংশে লকডাউন শিথিল করে ব্যবসা, গাড়ি চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে যখন অর্থনীতির চাকা কিছুটা সচল হচ্ছে, ঠিক তখনই ছুটে এল এক ‘সমুদ্রদানব’। বঙ্গোপসাগরে তৈরি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আমপান আছড়ে পড়ে বাংলাদেশের উপকূলে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলবিস্তীর্ণ জনপদ। কেড়ে নিল বেশ কিছু প্রাণ।

পূর্ব ভারতের একটা অংশ যখন আমপানের সঙ্গে লড়ছে, পশ্চিম ও মধ্যভারতের চার-পাঁচ রাজ্যে তখন হানা দিয়েছে আর এক শত্রু পঙ্গপালের দল। কোটি কোটি পতঙ্গের ঝাঁক রাজস্থান, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের আকাশে। প্রতিদিন নষ্ট করছে একরের পর একর জমির ফসল, খাদ্যশস্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি প্রমাণ আকারের পঙ্গপালের ঝাঁক এক দিনেই অন্তত আড়াই হাজার মানুষের খাবার খেয়ে নিতে পারে। এর আগেও এই সব এলাকায় হামলার নজির থাকলেও এবারের মতো এত বিপুল সংখ্যক পঙ্গপাল হানা দিতে দেখেননি বলেই জানাচ্ছেন প্রবীণরা। এক দিনে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতাধর এই পঙ্গপালের দলের নিশানায় যে এরপর কোন রাজ্য, সেই আতঙ্কে ঘুম উড়েছে একাধিক রাজ্যের বাসিন্দা থেকে প্রশাসনের। যে সব রাজ্যে হানা দিয়েছে, সেখানকার তোলা বহু ভিডিয়ো ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই ছবি দেখে রক্তে বয়ে যাচ্ছে শীতল স্রোত। আশঙ্কা, কৃষিপ্রধান বিপুল এই এলাকার শস্যভাণ্ডার নষ্ট হওয়ার ফলে গোটা দেশেই দেখা দিতে পারে খাদ্যাভাব। দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসও দিচ্ছেন অনেকে।

দাবানল প্রবণ রাজ্য হলেও এ বছর উত্তরাখণ্ড যেন জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড।বিশাল বিশাল বনভূমি জ্বলছে। ৪৬টি এলাকায় দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে।

চতুর্দিকে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়তে লড়তেই আরও এক বহিঃশত্রু মাথাচাড়া দিয়েছে। ‘রণং দেহি’ মেজাজে লাদাখ সীমান্তে সেনা বাড়াতে শুরু করেছে চিন। মঙ্গলবারও চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং দেশের সেনাবাহিনীকে জানিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে। প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারতও। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত-সহ তিন বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহও জানিয়ে দিয়েছেন, চিনা আগ্রাসন যত বাড়বে, ভারতও তার যোগ্য জবাব দেবে। অর্থাৎ, এ পারেও যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ। আগেও যে সীমান্ত বিবাদ ঘিরে চিন-ভারত দ্বন্দ্ব হয়নি এমন নয়। কিন্তু এ বার যেন উত্তেজনা একটু বেশিই ছড়িয়েছে।

বিভিন্ন দেশের এই দুর্যোগ, বিপর্যয়, সঙ্কট বা বিপদের মিলিত প্রভাবের কথা ভাবলেই আতঙ্কে শিউরে উঠছেন অনেকে। করোনায় অর্থনীতি পঙ্গু। সেই ক্ষত সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশবাসী ও সরকার। উপকূলিয় এলাকার লন্ডভন্ড পরিকাঠামো সামলে উঠতে বিপুল অর্থব্যয় করতে হবে। অথচ লকডাউনের জেরে সরকার ও জনগণের আয় তলানিতে। ভারতে পঙ্গপালের হানায় বাংলাদেশেও খাদ্যশস্যের ভাণ্ডারে টান পড়ার আশঙ্কা। মূল্যবৃদ্ধির পূর্বাভাস। চিন-ভারত যুদ্ধ হলে তার জন্যও সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। ফলে রাজকোষে টান পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও একটি বিপর্যয়ের প্রভাব যে শুধুমাত্র সেই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন নয়। বরং গোটা দেশের জনজীবন-অর্থনীতিতেই তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে চলেছে বলেই মনে করছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর..

ফেসবুকে আমরা

Facebook Pagelike Widget