রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসছে। ওই হাসপাতালে করোনা পরীক্ষায় (টেস্ট) যত অনিয়ম, তার সবটিতেই রয়েছে সেখানে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্যদের হাত। করোনা পরীক্ষার জন্য সিরিয়াল দেওয়া, নাম-ঠিকানা লেখা, নমুনা সংগ্রহের জন্য ডেকে নেওয়া এবং প্রতিবেদন দেওয়ার অনুষঙ্গিক সব কাজই করেন সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অবৈধ কারবার শুরু করেন কয়েকজন আনসার সদস্য। তাঁরা টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল এগিয়ে দিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিতেন। যাদের কাছ থেকে টাকা খসাতে পারতেন না তাদের সিরিয়াল পেছনে ফেলে হয়রানি করা হতো। সরকারি চাকরিজীবীদের সুবিধা পাইয়ে দিতে করোনা পরীক্ষার ভুয়া পজিটিভ ও নেগেটিভ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্যও চুক্তি করতেন তাঁরা। পাঁচ-ছয় হাজার টাকার উেকাচে হাসপাতালের প্যাডে পাশের কম্পিউটারের দোকান থেকে এসব প্রতিবেদন তৈরি করা হতো।
গত ১৫ জুন মুগদা হাসপাতালের সামনে থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই চক্রের প্রধান ছিলেন হাসপাতালেই দায়িত্বরত আনসার সদস্য ফজল হক। আসামিদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এদিকে শুক্রবারের ঘটনায় আফসার, বিশ্বজিৎ ও বিরাজ মল্লিক নামের তিন আনসার সদস্যকে প্রত্যাহার এবং তদন্ত কমিটি গঠনের পর সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী পরীক্ষায় সহায়তার সব কাজ থেকে আনসার সদস্যদের সরিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু গেটে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন কয়েকজন আনসার সদস্য। মুগদা হাসপাতালের দুটি বিব্রতকর ঘটনার পর আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে দেশের সব হাসপাতালে দায়িত্বরত সদস্যদেরও সতর্ক করা হয়েছে।
তদন্তকারী একাধিক সূত্র জানায়, মুগদা হাসপাতালে রোস্টার অনুযায়ী দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিতে যাওয়া লোকজনকে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। বেশি টাকা পেতে তাঁরা ভুয়া প্রতিবেদন তৈরির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই চক্রের হোতা ফজল হকের সঙ্গ সাংবাদিক নির্যাতনকারী আফসারও জড়িত।
১৫ জুন অভিযান চালিয়ে আলামতসহ চারজনকে আটক করে মুগদা থানায় পাঠায় র্যাব-৩। ১৬ জুন থেকে আদালতের নির্দেশে চারজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। রিমান্ড শেষে তাঁদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফয়সাল মুন্সী বলেন, ‘আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
তদন্ত সূত্র জানায়, ফজল হক, আফসারসহ কয়েকজন আনসার সদস্য পরীক্ষার জন্য আসা ব্যক্তিদের কাছে গোপনে জানতে চাইতেন নিজের ইচ্ছামতো পজিটিভ বা নেগেটিভ রিপোর্ট চায় কি না। আনসারের পোশাক পরা ব্যক্তির কথায় প্রলুব্ধ হয়ে অনেকে অবৈধ সুবিধা পেতে প্রতিবেদনের জন্য চুক্তি করত। হাসপাতালের সামনের কম্পিউটারের দোকানের মালিক শরিফ হোসেন ও লিয়াকত আলী এভাবে খদ্দের সংগ্রহ করতেন। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের প্যাডে নকল প্রতিবেদন তৈরি করে সরবরাহ করা হতো। কর্মচারী জামশেদসহ কয়েকজন ছিলেন সহায়তাকারী। দুই দোকান থেকে ৯৫টি প্রতিবেদনের প্যাড জব্দ করে র্যাব। চক্রটি আসল প্রতিবেদন স্ক্যান করে নকল প্রতিবেদন বানাত। এ ছাড়া তারা হাসপাতাল থেকে প্যাড সংগ্রহ করেছিল কি না এবং হাসপাতালের আরো কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে এ ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত আনসার সদস্যরা। ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিনই দুই বুথে ১০০ পরীক্ষা হয়। দক্ষিণ মান্ডার শাওন তাঁর মাকে নিয়ে আসেন গত শুক্রবার। তাঁর মায়ের সিরিয়াল ৩৬ হলেও আনসার সদস্যরা তাঁদের পরীক্ষা হবে না বলে চলে যেতে বলেন। এ নিয়ে বাগিবতণ্ডার ছবি তুলতে গেলে ফটো সাংবাদিক রুবেল রশিদকে আফসারের নেতৃত্বে মারধর করা হয়। আরেক ফটো সাংবাদিক জয়িতা রায়কেও হেনস্তা করা হয়। ভুক্তভোগী শাওন বলেন, ভোর ৫টায় লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন সিরিয়াল পাবেন ভাবছিলেন তখন তাঁদের চলে যেতে বলা হয়। একটি বুথে ৪০ বা ৫০ যে সংখ্যায়ই নেওয়া হোক না কেন, তাঁর মায়ের সিরিয়াল থাকবে। কারণ তাঁর নম্বর ৩৬। তিনি বলেন, ‘অনেকে টাকা দিয়ে সিরিয়াল এগিয়ে নিয়েছে। টাকা দিলে এরা সিরিয়ালের বাইরেও টেস্ট করে দেয়। এ কারণে অনেকেই লাইনে থেকেও বাদ পড়ে। আমি বিষয়টি বুঝে প্রতিবাদ করেছি।’
মুগদা হাসপাতালের ওসি প্রলয় কুমার সাহা বলেন, ‘ভুয়া প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ওই ঘটনায় অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। শুক্রবারের ঘটনায় সাংবাদিক রুবেল জিডি করেছেন। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার চেষ্টা করেছি। কারণ সেটি নষ্ট থাকায় পাওয়া যায়নি।’
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপপরিচালক (জনসংযোগ) মেহনাস তাবাসসুম রেবিন জানান, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি অসৌজন্যমূলক আচরণ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ নির্দেশনা দিয়েছেন।
Leave a Reply